আমাকে কতোটা দখল করে রেখেছিলে তুমি ঋতুপর্ণ সেটা এই জীবনে তোমাকে আমার বলাই হলো না। ভেবেছিলাম একবার না একবার, কোথাও না কোথাও তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবেই হবে। আর দেখা হলেই না হয় বলা যাবে কী অবলীলায় তুমি কেড়ে নিয়েছো আমার সময়। কী অবলীলায় তুমি আমাকে হাসিয়েছো, কাঁদিয়েছো, ভাবিয়েছো। মুগ্ধতার প্রবল স্রোতে তুমি আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছো। চেতনার গভীর স্তরে অপরূপ একটা সিম্ফনির দ্যোতনায় মৃদুমন্দ কাঁপন তুলে অন্যরকম প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিয়েছো মন ও মনন।
আমার ছিলো ছয়টি ঋতু। তুমি এসে যুক্ত হয়ে একটি ঋতু বাড়িয়ে দিলে! আমার হলো সাতটি ঋতু। চার ঋতুর দেশ কানাডায় পরবাসী হবার পরেও আমার ছিলো সাতটি ঋতু। তুমি চলে গেলে। একটি ঋতু হারিয়ে গেলো। আবার আমার ছয়টি ঋতু। তোমার ছবি দেখা হতো ঘুরে ফিরে ছয় ঋতুতে, ঋতুপর্ণ!
সিনেমার মায়াবী জগতে তুমি ছিলে এক বিস্ময়কর, জাদুকর। ঊনিশে এপ্রিল, বাড়িওয়ালি, উৎসব, তিতলি, চোখের বালি, রেইনকোট, দোসর, অন্তরমহল, আবহমান, চিত্রাঙ্গদা, সব চরিত্র কাল্পনিক—কী চমৎকার একেকটা আয়োজন তোমার! দেখেছি আর মুগ্ধ হয়েছি। মেধার ব্যাপ্তিতে মননের দ্যুতিতে তুমি ছিলে উজ্জ্বল এক সৃষ্টিশীল মানুষ। সিনেপত্রিকা আনন্দলোক-এর দায়িত্ব নিলে যখন, মুগ্ধ বিস্ময়ে পড়েছি তোমার নেয়া অসাধারণ ইন্টারভিউগুলো। কথাবার্তায় কী চৌকশই না ছিলে তুমি! নিজের ছবিতে (তিতলি তে?) গান লিখেও তুমি আমাকে চমকে দিয়েছিলে।–‘মেঘপিওনের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা/ মন খারাপ হলে কুয়াশা হয় ব্যাকুল হলে তিস্তা…।’
আহারে ঋতুপর্ণ, তুমি তো কবিও ছিলে! গানটি একবার শুনেই জানো অসাধারণ এই পঙ্ক্তিদুটো সঙ্গে সঙ্গেই চিরস্থায়ী ভাবে সেঁটে গিয়েছিলো মস্তিষ্কের দেয়ালে! স্মৃতি থেকেই উদ্ধার করলাম এখন, পঙ্ক্তিদুটো, এই মুহূর্তে তোমাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে।
সঞ্জয় নাগের ‘মেমোরিস ইন মার্চ’-এ তোমাকে প্রথম দেখলাম অভিনেতা হিশেবে। ওই চরিত্রে এমনভাবে মানিয়ে গিয়েছিলে তুমি যে মনে হচ্ছিলো তোমার জন্যেই নির্মিত হয়েছে ছবিটা। ওই ছবির মূল বক্তব্যটা আসলে তোমারই বক্তব্য ছিলো। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের রহস্যময়তাকে কী তীব্র ভাবেই না তুলে এনেছো তুমি অপরূপ মায়া আর অনির্বচনীয় ভালোবাসার মোড়কে!
তোমার চলে যাবার পর পত্রিকা-টিভি আর ইন্টারনেটভর্তি খবরের ঝাঁকের ভেতর থেকে একটা তথ্যে বেশ চমকিত হলাম—বয়েসে তুমি আমার খানিকটা ছোটই তো ছিলে! এখনো পঞ্চাশ হওনি! ঊনপঞ্চাশেই তোমার এই প্রস্থান কী করে মেনে নিই বলো! দৃশ্যপট থেকে এভাবে আচমকা অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটা তোমার কি উচিৎ হয়েছে ঋতুপর্ণ!
তোমার মৃত্যু আবারো প্রমাণ করেছে প্রকৃতির কাছে আমরা মানুষেরা কতো অসহায়! তোমার মতো একজন মেধাবী পুরুষকে নিয়ে প্রকৃতি কী রকম নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছিলো বলো! তোমাকে তাই লড়তে হয়েছে একই সঙ্গে কয়েকটি ফ্রন্টে। একদিকে বন্ধ্যা সময়ের বিরুদ্ধে শৈল্পিক সৃজনশীলতার লড়াই অন্যদিকে শারীরিকভাবে তোমার বদলে যাবার লড়াই। দুটোতেই লক্ষ্য করেছি তুমি ছিলে ড্যাম কেয়ার। সমাজের খুচরো তথাকথিত শিক্ষিত-অশিক্ষিত সিকি-আধুলি মানুষগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তুমি বেঁচেছিলে তোমার মতোন করে। তোমার ভেতর থেকে ক্রমশঃ জেগে ওঠা একজন নারীকে স্বাগত জানাতে দ্বিধাহীন তুমি ছিলে একদিকে আপসহীন অন্যদিকে অসম্ভব ছেলেমানুষ। পরিপূর্ণ নারী হবার জন্যে এতোটাই ব্যাকুলতা ছিলে, তোমার জন্য রিস্কি জেনেও শরীরে বাড়তি হরমোন প্রয়োগের ব্যাপারে ক্ষিপ্র হয়ে উঠেছিলে তুমি। তোমার ব্যক্তিগত জীবনটা একান্তই তোমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিলো কিন্তু এটাও তো ঠিক ঋতুপর্ণ—তুমি কেবল তোমারই ছিলে না। তুমি তো আমাদেরও ছিলে! এখন, তোমার এই অকাল প্রয়াণে আমরা যে আমাদের সময়ের সবচে ঝকঝকে চকচকে দীপ্যমান সৃজনশীল মানুষটিকে হারালাম!
বিদায় বন্ধু ঋতুপর্ণ ঘোষ! ভালো থেকো। তোমার বর্তমান ঠিকানা জানা নেই বলে এই চিঠিটা পাঠিয়ে দিলাম আকাশের ঠিকানায়। মেঘপিওনের কাছ থেকে তোমার নাম লেখা আমার এই নীল খামটা বুঝে নিও বন্ধু!